তকদির অর্থ কি? তকদির অর্থ কেউ কেউ বলে থাকেন ভাগ্য বা নিয়তি। এ তকদির সর্ম্পকে কোরআনে বলা হয়েছে বিশ্বাস রাখার জন্য। কারণ বিশ্বাস হচ্ছে অন্ত:করণ দ্বারা উপলব্ধি করা। আমরা যা চিন্তা ভাবনা করি তা সবই আমরা উপলব্ধি করি অন্ত:করণ দ্বারা। আর চিন্তা-ভাবনা করি বিবেক বা বুদ্ধি দ্বারা। আর প্রজ্ঞার দ্বারা সর্বোত্তমটি বেছে নেই। প্রজ্ঞার অভাবে আমরা সঠিক সময়ে সঠিক বিষয়টি বেছে নিতে ব্যর্থ হলে পরিণতিতে ভোগ করি সীমাহীন র্দুভোগ। বুদ্ধি আমাদের চলার পথে সাহায্য না করলে আমরা সঠিক পথটি হারিয়ে দুরে সরে যাই। অন্ত:করণ সাহায্য না করলে তা কঠোর মন-মানসিকতার পরিচয় বহন করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে তকদির বলতে এ তিনটি বিষয়েরই উপর নির্ভরশীলতাকে বোঝায় যার উপর বিশ্বাস রাখার জন্য ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে। কিন্ত্তু আপনি একটু লক্ষ্য করলেই এর বাস্তবতা উপলব্দি করতে পারবেন। দেখতে পারবেন এমন সবকিছু যা আপনার বিশ্বাসের ভিত্তিকেই নড়বড় করে দেবে। যেমন সাধক ইসমাইল শাহ তার ইসমাইল গীতিতে বলেছেন-

ভাগ্যের লিখন যায় না খন্ডন
সুখে কি দুঃখে থাকি
আমার পাওনা আমি পাব
পূর্বে যাহা করেছি।।

অর্থ – ভাগ্যের লিখন খন্ডানো যায় না। আমি সুখে থাকি কি দু:খে থাকি আমার পাওনা আমাকেই পেতে হবে। যা আমি পূর্বে করেছি। পূর্বে আমি কি করেছি তা কি আমার মনে আছে? আমি কোথায় ছিলাম? কার কাছে কোথায় জন্ম নিয়েছিলাম? কে ছিল আমার পিতা? কে ছিল আমার মাতা? তা আমি বিসৃত হয়েছি। এ জগতে আমি যাকে বাবা বা আমার জন্মদাতা বলে জানছি, মা বলে জানছি ভাই বা বোন বলে জানছি তারা আমার পূর্ব জনমে ছিল না। আমি ছিলাম হয়তো এরচেয়ে ভালো নয়তো এরচেয়ে মন্দ। ভালোতো নয়ই। বরং মন্দ ছিলাম। না হলে কেন আবার বাকী পাওনা মিটিয়ে দেয়ার জন্য এ পৃখিবীতে অন্য আরেক জগতে পাঠানো হলো? সাধক ইসমাইল শাহ এ বিষয়টি মেনে নিয়েছেন। অবতার মহারাজ আনন্দ স্বামী বলেছেনগর্ভস্থ হইবার পূর্বে ” বিশেষরুপে তোমার কাজ করিব ”  এই প্রতিজ্ঞা করিয়া জীব সংসারে আসে। জন্মিবামাত্র ওনা ওনা  বলে পূর্বের প্রতিজ্ঞা ভুলিয়া যায়।

একই দিনে এই ভ্রমে
কত শিশু জন্ম নিচ্ছে
কেহ্ রাজা কেহ্ প্রজা
নাপিত ধোপা চামার মুচি।।
নব শিশু হওয়ার পরে
নিস্পাপী বলে তাহারে
পূর্বে কি করেছো ওরে
কপালকে করেছি দোষী।।

অর্থ – এই বিশ্ব ব্রক্ষান্ডে নানা দেশে নানান বেশে কত শিশু জন্ম নিচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে কেহ রাজা কেহ প্রজা কেহ নাপিত ধোপা চামার মুচি হচ্ছে। অথচ জন্মের সময় প্রতিটি শিশুই নাকি নিষ্পাপ থাকে। যদি নিষ্পাপই থাকে তবে কেন আবার এ ধরাতে আগমণ করতে হলো? কেন অাবার ক্ষেত্র বিশেষে আমাতে জন্মলাভ করতে হলো অর্থাৎ আমি যদি রাজা হই আমার ঘরে যে সন্তান জন্ম নেবে সে রাজপুত্র, আমি নাপিত হলে আমার সন্তান হবে নাপিত আমি যদি মুচি হই আমার সন্তান হবে মুচির সন্তান। তার অর্থ আমি যা আমার সন্তান যে হবে সে তাই হবে। এটাই নিয়তি আবার এ নিয়তির উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংগ। এ প্রসংগে হযরত খাজা আবুল হাসান খেরকানী (রহ:) বলেছেন অদৃষ্টের উপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এক হাজার মকবুল উপাসনা অপেক্ষা উত্তম। শুধু শুধু কপাল বা নিয়তিকে দোষ দিতে তিনি নিষেধ করেছেন। কেননা পূর্বের কৃত কর্মের ফলেই এ জন্মলাভ। তার অর্থ – পিতা-মাতার খেসারত দিতে হবে সন্তানকে। সন্তানরা হচ্ছে খেলার পুতুল। যে আমি আজকে জন্ম লাভ করেছি সেই আমিই আমার কর্ম দোষে অন্য কোন জায়গায় অন্য কারো ঘরে জন্মলাভ করে সেই ভুলের মাশুল দিচ্ছি।

নিজের দোষে নিজে দোষীজেল খাটে এই হাজতবাসী
কারো গলায় পরে ফাঁসি
হাকিম থাকে নির্দোষী।।

অর্থ – পাপ হচ্ছে ভ্রান্তি বা ভুল। এ ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে ধরা পড়তে হচ্ছে দেহঘরে। বন্ধী হতে হচ্ছে খাচায়। দু:খ কষ্ট পোহাতে হচ্ছে। জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে আমি রুপী আত্মার। পাপের ফলে ক্ষেত্র বিশেষে অনেক বড় মাশুল দিতে হয়। বার বার এ দেহরুপ ঘরে লক্ষ লক্ষ যোনী ভ্রমণ করতে হয় যা অত্যন্ত দু:খকর। অথচ আত্মা সৃষ্টিকারী রায় প্রদানকারী থাকে নিদোর্ষী। কেন নিজেকে হাকিম নিদোর্ষী বলে দাবী করছেন? কারণ আমি নিজেই নিজের দোষে দোষী।

ইসমাইল শাহ্ ভেবে বলে
মানব জনম যায় বিফলে
এবার জন্মে কি করিলে
সাধন ভজন হয় নাই সুচি।।

অর্থ – এখানে ইসমাইল শাহ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করছেন – এবার তুমি জন্মে কি করছো? তুমি তোমার পূর্ব ভুল আবারো করতে চাও? আবারও কি যোনী ভ্রমণ করতে চাও? কেন সাধন ভজন কর না? কেন তোমার সাধন ভজন সুচি অর্থাৎ শুদ্ধ করো না? মানবরুপে জন্মেছো। অথচ সাধন ভজন না করলে তোমার মানব জনমই বিফলে যাবে। সুতরাং শুদ্ধ সাধন ভজন কর। অর্থাৎ যোনীভ্রমণ রোধ কর।

সারমর্ম – ইসমাইল গীতির এ গানটি পর্যালোচনা করলে দেথা যায় – একই দিনে এই ব্রক্ষান্ডে নানান দেশে নানান জাতের শিশু জন্মগ্রহণ করে থাকে। যারা হীন দরিদ্র তার ঘরে যে শিশুটি জন্মালো সে দারিদ্রতার করাল গ্রাসে পতিত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করবে। যে শিশু ধনীর ঘরে জন্মালো সে ধনীর দুলালী হিসেবে কালাতিপাত করবে। একই স্রষ্টা যদি তাদের সৃষ্টি করে থাকে তাহলে ক্ষেত্র বিশেষে কেন এ বৈষম্য সৃষ্টি হয়? কেহ হয় রাজা, কেহ প্রজা আর কেহ নাপিত, ধোপা, চামার, মুচি হয়? এর কারণ কি? অথচ প্রতিটি শিশুই নাকি নিষ্পাপ থাকে? কি এমন দোষ করেছিল যার কারণে তাদের এ পরিণতি ভোগ করতে হয়? বলা হয় পূর্ব জনমের কর্মের ফল ভোগ করার জন্যই নাকি এ পরিণতি তাদের ভোগ করতে হচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কর্মফল পাপ-পুণ্যের বিচারে যার যার প্রাপ্য তা  সে ভোগ করবে। অর্থাৎ ফল ভোগ করার জন্যই তাকে পুনরায় এ জগতে আবার পাঠানো হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে দেখা যাচ্ছে পাপ বা ভ্রান্তি হচ্ছে মনের ক্রিয়া যা সে করেছিল। সে ভুলের ক্রিয়ায় তাকে আবার  পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। বিষয়টি যদি একটু চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব – পাপ হচ্ছে দু’প্রকার। অর্জিত পাপ এবং সন্ঞ্চিত পাপ। অর্জিত পাপ – যা সে এ পৃথিবীতে এসে অর্জন করছে। আর সন্ঞ্চিত পাপের পরিণতিতেই তাকে আবার এ জগতে আসতে হয়েছে। কিন্ত্তু তারপরও কথা থেকে যায়। সেটা হলো যে দেশে যেটা পাপ বলে পরিগণিত হচ্ছে অন্য দেশে তা পূণ্য বলে গণ্য হচ্ছে। দেশের ক্ষেত্র বিশেষে আইনের সমাজের পারিপার্শ্বিক সবদিক থেকেই ভিন্নতা আছে। আছে ধর্মের ভিন্নতা। আছে বিশ্বাসের ভিন্নতা। সেক্ষেত্রে সবার জন্যইতো বিচার বা আইন স্রষ্টার জন্য এক হওয়ার কথা। তারপরও কেন এ বিশৃংখলা? কেন এ ভিন্নতা? কারণ সবার জন্যইতো একই স্রষ্টা। হযরত ইসমাইল শাহ এর সহজ উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-
নিজের দোষে নিজে দোষী
 জেল খাটে এই হাজতবাসী।
কারো গলে পড়ে ফাঁসি।
হাকিম থাকে নিদোর্ষী।
অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যে আমি আমার নিজের দোষেই দোষী। আর এ কারণেই আমি জেল হাজত খাটছি। তার মানে নিজের অজ্ঞতাই আমার পাপের কারণ। আমকে দেহ বন্ধী করার মুল কারণ হচ্ছে আমার অজ্ঞতা। এখানে হাকিমকে দোষ দেয়া যায় না। কারণ তিনি রায় দেয়ার মালিক। পাপ – পুণ্যের পাল্লায় যেটা ভারী সেদিকেই তিনি রায় দিয়ে থাকেন। রায় দেয়ার পূর্বে তিনি সমস্ত বিষয় সমুহ পুংখানুপুংখরুপে যাচাই বাছাই করে তবেই রায় প্রদান করেন। তা সে যে দেশেরই হোক না কেন? শাস্তি হয় সেদেশের প্রচলিত আইনেরই আওতায়। সে দেশের প্রচলিত আইন মোতাবেকই। এ ব্যাপারে কারো আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ অন্যায় করলে তার বিচার প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই করা  হয়। উকিল মোখতার সবই সে দেশের আইন মোতাবেকই হয়। বিধি বিধান স্রষ্টা প্রথম থেকেই দিয়ে আসছেন। এখনো দিতেছেন এবং এ ধারা অব্যাহত আছে এবং থাকবে। আর এজন্যই প্রতিটি ধর্ম গ্রন্থের মুল কথা হলো – আত্মানং বিধি। আত্মানং বিধি হলেই হাকিমের রায় দেয়ার বিষয়টি বোধগম্য হবে। জন্মরোধ হবে। আর এ ধরাতে আসতে হবে না। তখন আমি হয়ে যাব লীন। তথা মহা আত্মার সাথে সম্মিলন হবে। এতেই পরম শান্তি নিহিত। এটাই মানব জনমের স্বার্থকতা।
মানুষ থেকেই মানুষ আসে
বিরুদ্ধতার ভিড় বাড়ায়
আমরা মানুষ তোমরা মানুষ
তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়।
সংগ্রিহিত

Leave a Reply